ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক (প্রথম অধ্যায়)

নবম শ্রেণী ইতিহাস – SAQ (৩ মার্কস) বিশদ ব্যাখ্যামূলক উত্তর

১. টেইলি কী?
উ: টেইলি ছিল ফ্রান্সে বিপ্লবের পূর্বে প্রচলিত একটি প্রত্যক্ষ কর বা সম্পত্তি কর। এটি মূলত ফরাসিদের জমির মূল্য বা সম্পত্তি অনুযায়ী ধার্য করা হতো। কিন্তু বাস্তবে এই করের বোঝা সাধারণ কৃষক এবং মধ্যবিত্তের উপর বেশি পড়ত, কারণ যাজক এবং অভিজাতরা প্রায়শই কর থেকে অব্যাহতি পেত। টেইলি করের কারণে সাধারণ মানুষদের আর্থিক দায়ভার খুব বেড়ে যেত এবং এটি সমাজে অসাম্য ও অসন্তোষের একটি বড় কারণ ছিল।

২. ক্যাপিটেশন কী?
উ: ক্যাপিটেশন ফরাসি সমাজে প্রচলিত এক ধরনের প্রত্যক্ষ কর, যা মূলত উৎপাদন বা আয় ভিত্তিক ধার্য করা হতো। বিপ্লবের পূর্বে এই কর সাধারণ জনগণকে দিতে হতো, কিন্তু যাজক ও অভিজাতরা প্রায়শই এ থেকে অব্যাহতি পেত। ফলে সাধারণ কৃষক ও শ্রমিকদের উপর করের বোঝা বেড়ে যেত এবং এটি বিপ্লবের পূর্ববর্তী অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি উদাহরণ।

৩. ভিংটিয়েমে কী?
উ: ভিংটিয়েমে ছিল ফরাসিতে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির উপর ধার্য একটি আয়কর। এই কর মূলত কৃষকরা দিত এবং মোট আয়ের ৫% হিসেবে ধার্য ছিল। যদিও অভিজাতরা কিছুটা কর দিতেন, তবে যাজকরা সম্পূর্ণ করমুক্ত থাকতেন। ভিংটিয়েমে ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে চালু হয় এবং এটি সাধারণ মানুষের উপর করের বোঝা বৃদ্ধি করেছিল, যা বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচিত।

৪. টাইথ কী?
উ: টাইথ বা ধর্মকর ফরাসি সমাজে তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষেরা চার্চ বা গির্জাকে প্রদান করত। এটি সাধারণত উৎপন্ন ফসলের ১০% হিসেবে ধার্য হতো। এই করের ফলে কৃষক ও সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক বোঝা বৃদ্ধি পেত, এবং ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে অসাম্য প্রকট হতো।

৫. অ্যাসাইনেট কী?
উ: অ্যাসাইনেট হল ফ্রান্সে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে সংবিধান সভার মাধ্যমে চালু করা কাগজের নোট। অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য গির্জার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সেই সম্পত্তির বিপরীতে এই নোট ইস্যু করা হয়। এটি মূলত অর্থের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো এবং ফরাসি অর্থনীতি সাময়িকভাবে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছিল।

৬. ব্রান্সউইক ঘোষণা কী?
উ: ব্রান্সউইক ঘোষণা হল প্রাশিয়ার ডিউক, ডিউক অফ ব্রান্সউইকের একটি ঘোষণা। এতে বলা হয়েছিল যে, ফরাসি রাজপরিবারের নিরাপত্তা যদি কোনোভাবেই বিঘ্নিত হয়, তাহলে তিনি প্যারিস ধ্বংস করে দেবেন। এটি ফরাসি জাতির প্রতি চরম অপমানের প্রতীক ছিল এবং বিপ্লবী মানসিকতাকে আরও উদ্দীপিত করেছিল।

৭. ফ্রান্সকে ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর কে বলেছেন এবং কেন?
উ: বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ ফ্রান্সকে ‘ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর’ বলেছেন। কারণ ফ্রান্সে করব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক। যাজক ও অভিজাতরা করমুক্ত থাকলেও দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকদের উপর সমস্ত কর চাপানো হতো। এর ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেত এবং সাধারণ মানুষের জীবন যাপনে অচল অবস্থা সৃষ্টি হতো।

৮. রাজনৈতিক কারাগার কী?
উ: বাস্তিল দুর্গকে ফ্রান্সে বিপ্লবের পূর্বে ‘রাজনৈতিক কারাগার’ বলা হতো। এখানে রাজকীয় কর্মচারীরা যেকোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে আটক করতে পারতেন। বিশেষ করে রাজতন্ত্রবিরোধী মত প্রকাশকারীদের এখানে আটক রাখা হতো। উদাহরণস্বরূপ, দার্শনিক ভলতেয়ারকেও বাস্তিলে আটক রাখা হয়েছিল। এই দুর্গ রাজনৈতিক শাসনের অত্যাচারের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো।

৯. ইনটেনডেন্ট (Intendant) কাকে বলে?
উ: ইনটেনডেন্ট হল ফরাসি প্রাদেশিক প্রশাসনের এক বিশেষ ক্ষমতাশালী কর্মচারী। বুরবো শাসনকালে তারা রাজস্ব সংগ্রহ, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, সৈন্যসংগ্রহ এবং স্থানীয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করত। লেফেভরের মতে, এই কর্মচারীদের অত্যাচারের ফলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত।

১০. প্রথম সম্প্রদায় কারা?
উ: ফরাসি সমাজে প্রথম সম্প্রদায় বা First Estate হলেন যাজকরা। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১,২০,০০০। জনসংখ্যার মাত্র ১%-এরও কম হলেও তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশাল প্রভাবশালী ছিলেন। কর দিতে হত না এবং আইনের ঊর্ধ্বে ছিলেন।

১১. তৃতীয় সম্প্রদায় কারা?
উ: তৃতীয় সম্প্রদায় বা Third Estate বলতে যাজক ও অভিজাতদের ছাড়া ফরাসি সমাজের সমস্ত সাধারণ মানুষকে বোঝানো হয়। এর মধ্যে ছিলেন বুর্জোয়া (মধ্যবিত্ত), কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, দোকানদার এবং সাকুলাও। জনসংখ্যার প্রায় ৯৭% এদেরই অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রের সমস্ত কর এই সম্প্রদায়ের উপর চাপানো হতো, অথচ তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশেষ কোনো মর্যাদা পেত না।

১২. বুর্জোয়া কারা?
উ: বুর্জোয়া হলেন তৃতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত মধ্যবিত্ত। এরা অর্থ, শিক্ষা ও বুদ্ধিতে শক্তিশালী হলেও বংশকৌলিন্য বা সমাজের ঐতিহ্যগত মর্যাদায় অধিকারী ছিলেন না। তারা সমাজে অধিকারহীন হলেও বিপ্লবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

১৩. সাকুলােৎ কারা?
উ: সাকুলােৎ বলতে বোঝানো হয় শহরের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের, যেমন দিনমজুর, কুলি, মালি, ভিস্তি (জলবাহক), কাঠুরে, চাকর ইত্যাদি। ফরাসি বিপ্লবে তারা আন্দোলনের অন্যতম শক্তিশালী অংশ ছিল।

১৪. মন্তেস্কু কে ছিলেন এবং তার দুটি গ্রন্থের নাম?
উ: মন্তেস্কু ছিলেন একজন ফরাসি দার্শনিক। তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক এবং রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতার বিরোধী। তাঁর প্রভাব ফরাসি সমাজকে রাজনৈতিক চিন্তায় প্রভাবিত করেছিল। দুইটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল The Spirit of Laws এবং The Persian Letters

১৫. অভিজাত বিদ্রোহ কী?
উ: ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই দেশের সমস্ত প্রাদেশিক পার্লামেন্ট মুলতুবি করলে ও কর আদায় শুরু করলে সুবিধাভোগী অভিজাতরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাজবিরোধী বিদ্রোহ শুরু করে। এটি ‘অভিজাত বিদ্রোহ’ বা অভিজাত বিপ্লব নামে পরিচিত।


নিশ্চয়ই! আমি তোমার দেওয়া উত্তরগুলোকে পুরোপুরি বিশদ, বর্ধিত ও ১০০% ইউনিক ভাষায় সাজিয়ে দিচ্ছি। এগুলো লিখলে পরীক্ষায় ৫ মার্কসের জন্যও যথেষ্ট হবে।


ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক (প্রথম অধ্যায়)

নবম শ্রেণী ইতিহাস – বড় প্রশ্ন (৫ মার্কস) বিশদ ব্যাখ্যামূলক উত্তর


১. ফ্রান্সের করব্যবস্থা বৈষম্যমূলক ছিল কেন?

উ: ফ্রান্সের বিপ্লবের পূর্ববর্তী করব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বৈষম্যমূলক ছিল। মূল কারণ ছিল ফরাসি রাজাদের কোনো সুনির্দিষ্ট রাজস্বনীতি না থাকা। বাজেট তৈরি করা হতো না এবং অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে একধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করত।

  • করভার প্রভাব: ফরাসি সমাজে সমস্ত করের বোঝা প্রধানত তৃতীয় সম্প্রদায়ের উপর চাপানো হতো। মোট রাজস্বের প্রায় ৯৬% কর দিতে হত সাধারণ মানুষদের, অর্থাৎ মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র কৃষকদের। অন্যদিকে প্রথম সম্প্রদায় (যাজক) এবং দ্বিতীয় সম্প্রদায় (অভিজাত) মোট করের মাত্র ৪% প্রদান করত।
  • কর আদায়ের দুর্বলতা: কর আদায়ের জন্য রাজ্য কিছু বিশেষ কর্মচারী (ফারমিয়ের জেনারেল) ও অভিজাতদের দায়িত্ব দিত। তারা প্রজাদের কাছ থেকে শুধু ধার্যকৃত করই নয়, অতিরিক্ত কর আদায় করত এবং প্রয়োজনে অকথ্য অত্যাচার চালাত। বাণিজ্যশুল্ক আদায়কারীরা সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ করত এবং সাধারণ বণিকদের উপর চাপ প্রয়োগ করত।
  • সমাজে প্রভাব: এই বৈষম্য ও দুর্নীতি ফরাসি সমাজে অসাম্য সৃষ্টি করেছিল। সাধারণ মানুষ এবং দরিদ্র কৃষকরা করের বোঝা বহন করতে বাধ্য হলেও সমাজে মর্যাদা, সম্পদ ও সুবিধা প্রাপ্ত অভিজাতরা করমুক্ত ছিলেন।

ফলস্বরূপ, বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তৎকালীন ফ্রান্সকে ‘ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর’ (Museum of Economic Errors) বলেছিলেন। এই অসাম্য ও অযৌক্তিক করব্যবস্থাই ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


২. ফ্রান্সকে ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর বলা হয় কেন?

উ: ফরাসি অর্থনীতি বিপুলভাবে দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ ছিল, যা ফরাসি বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। প্রধান কারণগুলো হলো:

  • ত্রুটিপূর্ণ করব্যবস্থা: ফরাসি সমাজের অভিজাত ও যাজকরা রাজ্যের সবচেয়ে বড় জমির মালিক হলেও তারা মোট রাজস্বের মাত্র ৪% কর প্রদান করতেন। তৃতীয় সম্প্রদায়কে মোট রাজস্বের ৯৬% বহন করতে হতো।
  • অতিরিক্ত ব্যয় ও বিলাসিতা: চতুর্দশ ও ষোড়শ লুই-এর শাসনকালে ব্যয়সংকোচে অনিচ্ছা এবং রাষ্ট্রীয় বিলাসিতা অর্থনীতিকে দুর্বল করেছিল। বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যয় এবং রাজকীয় উদাসীনতা রাজকোষকে শূন্যের কোটায় নিয়ে আসে।
  • অর্থনৈতিক সংকট: জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও শস্যহানি ফরাসি অর্থনীতিকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্রাক্-বিপ্লবের সময় এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করে।

এইসব কারণে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ ফ্রান্সকে ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর বলে অভিহিত করেছিলেন। অর্থাৎ ফরাসি সমাজে সম্পদ ও করের মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা ও বৈষম্য ছিল, তা বিপ্লবের জন্মদাতা হিসেবে কাজ করে।


৩. সাঁকুলােৎ (Sans-culottes) বলতে কী বোঝায়?

উ: সাঁকুলােৎ ফরাসি বিপ্লবের সময় শহরের নীচুতলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের বোঝাতে ব্যবহৃত শব্দ। এদের আভিধানিক অর্থ হলো “যারা কুলােৎ পরেন না” – অর্থাৎ ব্রিচেস বা ট্রাউজার ছাড়া সাধারণ প্যান্ট পরা মানুষ।

  • জনসংখ্যা: ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্যারিস শহরের অধিকাংশ মানুষ সাঁকুলােৎ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন।

  • সমাজ ও জীবনযাত্রা:

    • তারা শহরের নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করত।

    • দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করত, পেট চালাতে হতো এবং কাজ না থাকলে ভিক্ষা করত।

    • অনেকেই ছোটখাটো অপরাধ বা অসামাজিক কাজেও যুক্ত থাকত।

    • ধনী ও অভিজাতরা তাদেরকে ঘৃণা করত, কিন্তু বিপ্লবের সময় তারা আন্দোলনের শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে কাজ করেছিল।

  • বিপ্লবে ভূমিকা: ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গের পতন থেকে শুরু করে সাঁকুলােত্রই ফরাসি বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তারা সাধারণ মানুষের দাবির প্রতীক এবং বিপ্লবের কর্মক্ষম বাহিনী হিসেবে পরিচিত।