নেপালে অস্থিরতা: তরুণদের আন্দোলন, সহিংসতা ও অন্তর্বর্তী সরকারের সন্ধান (১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫)

 Welcome to DailyUpdate





ভূমিকা

২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নেপাল এক গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশের তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে Gen Z বা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া যুবক-যুবতীরা, দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা দাবি করছে স্বচ্ছ রাজনীতি, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন এবং নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব। এই আন্দোলন এখন এতটাই ব্যাপক রূপ নিয়েছে যে, সরকার পতনের মুখে এবং পুরো দেশ অস্থিরতায় নিমজ্জিত।


বিক্ষোভের পটভূমি

নেপাল একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতার দেশ। রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরের পরও দুর্নীতি, দলাদলি এবং অকার্যকর প্রশাসন দেশের অগ্রগতিকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়েছে।

তরুণ প্রজন্ম, যাদের অনেকেই শিক্ষিত, প্রযুক্তি-সচেতন এবং বৈশ্বিক যোগাযোগে যুক্ত, তারা পুরনো রাজনৈতিক কাঠামোকে আর মেনে নিতে পারছে না। ফেসবুক, টিকটক, এক্স (টুইটার) এর মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তারা আন্দোলন সংগঠিত করছে।


বিক্ষোভের বর্তমান চিত্র

গত কয়েকদিন ধরে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু এবং অন্যান্য বড় শহরে তরুণদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ চলছে। এই বিক্ষোভে দুর্নীতি বন্ধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, এবং অন্তর্বর্তীকালীন নতুন সরকারের দাবি উঠছে।

কিন্তু বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ অবস্থায় থাকেনি। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। সরকারি ভবন, গাড়ি, এমনকি কারাগারও আক্রমণের শিকার হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় যে, একাধিক কারাগার ভেঙে যায় এবং হাজার হাজার বন্দি পালিয়ে যায়।


সহিংসতা ও প্রাণহানির সংখ্যা

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৫১ জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা কয়েক শতাধিক। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে কারাগার ভাঙচুরে। প্রায় ১৩,৫০০ জন বন্দি পালিয়ে যায়, যাদের মধ্যে ১২,৫০০ জন এখনও নিখোঁজ। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক আরও বেড়েছে।


অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর সন্ধান

চলমান সংকটের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো—অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন। তরুণ আন্দোলনকারীরা দাবি তুলেছেন যে পুরনো রাজনৈতিক নেতা নয়, বরং একজন সৎ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তি এই দায়িত্ব নেবেন।

এই প্রেক্ষাপটে আলোচনায় এসেছে নেপালের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুশিলা কার্কি-র নাম। তিনি দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি ছিলেন এবং দুর্নীতি বিরোধী কড়া অবস্থানের জন্য পরিচিত। তরুণরা মনে করছে, তিনি দেশের অন্তর্বর্তীকালীন নেতৃত্বের জন্য উপযুক্ত হতে পারেন।

“রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখনও সমঝোতা হয়নি, তাই অনিশ্চয়তার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।”

সরকারের প্রতিক্রিয়া

প্রথমদিকে সরকার আন্দোলন দমন করতে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো বন্ধ করে দেয়। ফেসবুক, এক্স (টুইটার) ও ইউটিউব সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এই পদক্ষেপ ব্যাপক সমালোচিত হয় এবং কয়েকদিন পর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয় সরকার।

এছাড়া দেশজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়েছে, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। তবুও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।


রাষ্ট্রপতি ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা

সংকট নিরসনে নেপালের রাষ্ট্রপতি রাম চন্দ্র পৌডেল ও সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করছেন। সেনাবাহিনী চাইছে দ্রুত একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হোক, যাতে দেশ আবার স্থিতিশীলতার পথে ফিরে আসে।

তবে ভাবার বিষয় হলো—রাজনৈতিক দলগুলো কি সত্যিকারের ঐক্যের পথে নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করবে কি না?”


সাধারণ মানুষের দুঃশ্চিন্তা

এই আন্দোলন ও সহিংসতার কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দোকানপাট বন্ধ, পরিবহন ব্যবস্থা অচল, খাদ্য ও ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। পর্যটন খাত, যা নেপালের অর্থনীতির একটি বড় অংশ, প্রায় ধ্বংসের মুখে।

অনেক পরিবার ভয় পাচ্ছে—যদি পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, তবে দেশে গৃহযুদ্ধের মতো অবস্থা তৈরি হতে পারে।


ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

নেপালের ভবিষ্যৎ এখন মূলত নির্ভর করছে তিনটি বিষয়ে—

  1. অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন এবং কীভাবে নির্বাচিত হবেন।
  2. “প্রশ্ন হলো—তরুণ আন্দোলনকারীরা কি শান্তিপূর্ণভাবে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে রাজি হবেন?”

  3. রাজনৈতিক দলগুলো কি সত্যিই সংস্কারের পথে যাবে, নাকি আবারও দলাদলি ও ক্ষমতার লড়াই চলতে থাকবে।

যদি সুশিলা কার্কির মতো গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তি নেতৃত্ব নেন, তবে কিছুটা শান্তি ফিরতে পারে। তবে যদি দলগুলো ক্ষমতার লোভে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, তবে দেশ আরও গভীর সংকটে পড়বে।


উপসংহার

নেপালের বর্তমান পরিস্থিতি শুধু একটি দেশের রাজনৈতিক সংকট নয়, বরং একটি প্রজন্মের হতাশা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন। তরুণরা চায় দুর্নীতি মুক্ত, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ একটি রাষ্ট্র। আর এই দাবি শুধু নেপালের নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের কণ্ঠস্বর।

এখন সময়ই বলে দেবে—নেপাল কি নতুন এক রাজনৈতিক যুগে প্রবেশ করবে, নাকি আবারও পুরনো অস্থিরতায় ডুবে যাবে।


Post a Comment

We’d love to hear your thoughts! Share your comment below.

Previous Post Next Post