মাটির তল থেকে জল স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওঠার কারণ | ভূগর্ভস্থ জলের গতি ও কৈশিকতা

 মাটির তল থেকে জল স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওঠার কারণ | ভূগর্ভস্থ জলের গতি ও কৈশিকতা

মাটির তল থেকে জল স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওঠার কারণ | ভূগর্ভস্থ জলের গতি ও কৈশিকতা




ভূমিকা

জল পৃথিবীর জীবনের মূল ভিত্তি। আমরা আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের জন্য নদী, পুকুর, হ্রদ, নলকূপ এবং ভূগর্ভস্থ জলের ওপর নির্ভর করি। তবে অনেক সময় দেখা যায়, মাটির তল থেকে জল নিজে নিজেই ওপরে উঠে আসে বা গাছপালা সেই জল শোষণ করে নেয়। এই ঘটনাটি আমাদের কাছে “অটোমেটিক জল ওঠা” মনে হলেও এর পেছনে রয়েছে বিজ্ঞানের কিছু নিয়ম – যেমন কৈশিক ক্রিয়া (Capillarity), শোষণ বল (Adhesion এবং Cohesion), ওসমোসিস (Osmosis) এবং মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ভূমিকা।

এখন আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব, মাটির তল থেকে জল ওঠার কারণ কী, কীভাবে তা কাজ করে এবং এর বাস্তব প্রয়োগ কোথায় দেখা যায়।


১. মাটির গঠন ও জলের সঞ্চালন

মাটি মূলত বিভিন্ন আকারের দানা বা কণিকা দিয়ে গঠিত – যেমন বালি, দোআঁশ, কাদামাটি ইত্যাদি। কণার আকার যত ছোট হবে, কণাগুলির মধ্যে ফাঁক বা ছিদ্রও তত ছোট হবে। এই ক্ষুদ্র ছিদ্র বা রন্ধ্রগুলির মাধ্যমে মাটির ভেতরে জল জমা থাকে এবং উপরের দিকে সঞ্চালিত হতে পারে।

  • বালুকাময় মাটি: ছিদ্র বড় হওয়ায় জল দ্রুত নীচে নেমে যায়, তবে ওপরে ওঠা কম হয়।
  • কাদামাটি: ছিদ্র ছোট হওয়ায় জল সহজে বের হতে পারে না, তাই জল ওপরে ওঠে ধীরে ধীরে কিন্তু স্থায়ীভাবে।
  • দোআঁশ মাটি: এটির ছিদ্র মাঝারি হওয়ায় জল চলাচল সুষম হয়।


২. কৈশিক ক্রিয়া (Capillarity) – মূল কারণ

মাটির তল থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জল ওঠার প্রধান কারণ হলো কৈশিক ক্রিয়া।

কৈশিক ক্রিয়া হলো – কোনো তরল যদি খুব সরু নল বা ফাঁক (capillary tube) দিয়ে প্রবাহিত হয়, তবে সেটি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে উপরের দিকে উঠে যেতে পারে।

কেন এমন হয়?

  • Adhesion Force (আনুবন্ধ শক্তি): জলকণিকা ও মাটির কণিকার মধ্যে আকর্ষণ।
  • Cohesion Force (সংযোজন শক্তি): এক জলকণিকার সাথে আরেক জলকণিকার আকর্ষণ।

যখন জল মাটির ক্ষুদ্র ছিদ্রের ভেতরে থাকে, তখন adhesion force বেশি কার্যকর হয়। এর ফলে জলকণিকা কণার গায়ে লেগে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। cohesion force বাকিদের টেনে নিয়ে আসে।

👉 একে আমরা নলকূপের নিচে বা গাছপালার শিকড়ের মধ্যে স্পষ্টভাবে দেখতে পাই।


৩. শোষণ বল (Imbibition)

মাটির কিছু অংশ যেমন কাদা বা হিউমাস জলে ভিজলে ফুলে ওঠে। এরা জলকে টেনে নেয় এবং ধরে রাখে। শোষণের ফলে জল নীচ থেকে ওপরে উঠতে পারে।


৪. গাছের শিকড়ের ভূমিকা

গাছপালা মাটির নিচ থেকে জল শোষণ করে নেয়। শিকড়ের কোষে অস্মোসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জল প্রবেশ করে। যেহেতু শিকড় কোষের ভেতর লবণ ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের ঘনত্ব বেশি থাকে, বাইরের জল সেখানে প্রবেশ করে এবং কাণ্ডের মাধ্যমে উপরের দিকে উঠে যায়।

গাছের ভেতরে Transpiration Pull নামক একটি প্রক্রিয়া থাকে। পাতার মাধ্যমে জলীয় বাষ্প বের হয়ে গেলে ওপরে ফাঁকা স্থান তৈরি হয়। ফলে নিচ থেকে নতুন জল ওপরে উঠতে থাকে।


৫. মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বনাম কৈশিক শক্তি

  • মাধ্যাকর্ষণ শক্তি জলকে নিচে টেনে নামায়।

  • কৈশিক শক্তি জলকে উপরে তোলে।

যদি মাটির ছিদ্র ছোট হয়, তবে কৈশিক শক্তি বেশি কার্যকর হয় এবং জল সহজেই উপরে উঠে আসে।


৬. ভূগর্ভস্থ জলের স্তর (Water Table)

মাটির নিচে একটি স্তর থাকে যেখানে ছিদ্রগুলো পুরোপুরি জল দিয়ে ভরা থাকে। একে বলে জলস্তর (Water Table)

জলস্তর যত উপরে থাকবে, তত সহজে জল ওপরে উঠবে। আবার গ্রীষ্মকালে যখন জলস্তর নিচে নেমে যায়, তখন গাছপালা জল পেতে কষ্ট করে।


৭. বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগ

  • নলকূপ: আমরা যখন নলকূপ খুঁড়ি, তখন কৈশিক ক্রিয়া ও চাপের কারণে জল ওপরে উঠে আসে।
  • গাছপালা: শিকড়ের মাধ্যমে জল টেনে উপরে পাঠানো হয়।
  • ভেজা কাপড় শুকানো: যখন কাপড়ের একপাশ জলে ডুবিয়ে রাখা হয়, তখন জলে ভিজে থাকা অংশ থেকে জল ধীরে ধীরে ওপরে উঠে যায়।
  • মোমবাতি জ্বলা: মোমবাতির সলতেতে তেল বা মোম কৈশিক ক্রিয়ায় উপরে উঠে শিখাকে জ্বালায়।


৮. কৈশিক ক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল ফ্যাক্টর

  1. মাটির দানার আকার – দানা ছোট হলে জল বেশি ওপরে ওঠে।
  2. জলের তাপমাত্রা – তাপমাত্রা বেশি হলে জল দ্রুত সঞ্চালিত হয়।
  3. লবণাক্ততা – লবণ মিশ্রিত জল তুলনামূলক কম ওপরে ওঠে।
  4. মাটির আর্দ্রতা – শুষ্ক মাটিতে জল দ্রুত টেনে নেয়।


৯. পরীক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্ব

নবম শ্রেণীর ভূগোল ও জীবনবিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ে কৈশিক ক্রিয়া ও ভূগর্ভস্থ জলের গতি সম্পর্কে প্রশ্ন প্রায়ই আসে। যেমন –

  • মাটির তল থেকে জল কেন ওঠে?
  • কৈশিক ক্রিয়া কী?
  • গাছের শিকড় কীভাবে জল শোষণ করে?

এসব প্রশ্নের উত্তর বুঝতে পারলে শুধু পরীক্ষাই নয়, বাস্তব জীবনেও প্রয়োগ জানা যায়।


১০. উপসংহার

মাটির তল থেকে জল ওঠার ঘটনাটি স্বাভাবিক হলেও এর পিছনে কাজ করছে বিজ্ঞানের নানা শক্তি – কৈশিক ক্রিয়া, শোষণ বল, cohesion, adhesion এবং ওসমোসিস। গাছপালা বেঁচে থাকার জন্য এই প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল। তাই আমরা বলতে পারি, মাটির ভেতরের জল মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে উপরের দিকে ওঠে কেবল কৈশিক শক্তি ও শোষণের কারণে।

এই প্রক্রিয়া না থাকলে গাছ বেড়ে উঠত না, কৃষি হত না এবং জীববৈচিত্র্য টিকত না।


Post a Comment

We’d love to hear your thoughts! Share your comment below.

Previous Post Next Post