📚 সপুষ্পক উদ্ভিদের যৌন জনন
ভূমিকা
সপুষ্পক উদ্ভিদ বা Angiosperm হলো পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ও বিস্তৃত উদ্ভিদগোষ্ঠী। এরা ফুল নামক বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে যৌন জনন সম্পন্ন করে এবং বীজ ও ফল উৎপাদন করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভিদে জেনেটিক বৈচিত্র্য, নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব এবং প্রজাতির টিকে থাকা নিশ্চিত হয়। তাই সপুষ্পক উদ্ভিদের যৌন জনন শুধু জীববিজ্ঞানের দিক থেকে নয়, মানব সভ্যতার খাদ্য ও অর্থনীতির সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত।
আদর্শ ফুলের বিভিন্ন অংশ
একটি পূর্ণাঙ্গ বা আদর্শ ফুলে চারটি প্রধান অংশ থাকে –
- বৃত্য (Calyx): সবুজ, কুঁড়িকে সুরক্ষা দেয়।
- পাপড়ি (Corolla): রঙিন, পতঙ্গ আকর্ষণ করে।
- পুংকেশর (Androecium): পুরুষ প্রজনন অঙ্গ, পরাগ উৎপাদন করে।
- স্ত্রীকেশর (Gynoecium): স্ত্রী প্রজনন অঙ্গ, অণ্ডাশয়ে অণ্ডাণু থাকে।
প্রতিটি অংশ জনন প্রক্রিয়ায় বিশেষ ভূমিকা রাখে।
পরাগরেণু উৎপাদন
- পুংকেশরের অগ্রকেশর (Anther) এ থাকে চারটি পরাগকোষ।
- প্রতিটি পরাগকোষে পরাগমাতা কোষ (MMC) থাকে।
- MMC মাইয়োসিসের মাধ্যমে চারটি হ্যাপলয়েড পরাগকণা তৈরি করে।
-
পরাগকণার ভেতরে থাকে –
-
জেনারেটিভ কোষ: দুটি শুক্রাণু উৎপন্ন করে।
-
টিউব কোষ: পরাগনালি তৈরি করে।
-
স্ত্রীরেণুর উৎপত্তি ও পরিস্ফুটন
- স্ত্রীরেণু অণ্ডাশয়ের ভেতরে অণ্ডাণুতে তৈরি হয়।
- একটি অণ্ডাণুতে থাকে নিউসেলাস ও অণ্ডকোষ।
- অণ্ডকোষের ভেতরে একটি মেগাস্পোর মাতা কোষ (MMC) থাকে।
- মাইয়োসিসের ফলে চারটি মেগাস্পোর তৈরি হয়।
- একটি কার্যকর থাকে, বাকিগুলি ক্ষয় হয়।
- কার্যকর মেগাস্পোর বারবার মাইটোসিস বিভাজন করে ভ্রূণথলি (Embryo sac) গঠন করে।
-
ভ্রূণথলিতে থাকে –
-
১টি ডিম্বকোষ
-
২টি সহায়ক কোষ (Synergids)
-
৩টি প্রতিকোষ (Antipodals)
-
২টি মেরুকেন্দ্রক → মিলে যায় → দ্বিতীয় কেন্দ্রক (Secondary nucleus)
-
পরাগযোগ (Pollination)
সংজ্ঞা: পরাগরেণুর গর্ভমুণ্ডে স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে পরাগযোগ বলে।
প্রকারভেদ
-
স্বপরাগযোগ (Self-pollination): একই ফুল বা একই উদ্ভিদের ফুলে ঘটে।
-
ইতর পরাগযোগ (Cross-pollination): এক ফুল থেকে অন্য ফুলে ঘটে।
স্বপরাগযোগ
-
প্রকারভেদ:
-
অটোগ্যামি (একই ফুলে)
-
গেইটনোগ্যামি (একই গাছে কিন্তু ভিন্ন ফুলে)
-
-
সুবিধা: সহজ, নির্দিষ্ট।
-
অসুবিধা: জেনেটিক বৈচিত্র্য কম।
ইতর পরাগযোগ
- ঘটে ভিন্ন গাছের মধ্যে।
- মাধ্যম – বায়ু (Anemophily), জল (Hydrophily), পতঙ্গ (Entomophily), পাখি (Ornithophily)।
- এর ফলে বৈচিত্র্য ও অভিযোজন বৃদ্ধি পায়।
ইতর পরাগযোগের অভিযোজন
- উজ্জ্বল পাপড়ি ও মধু → পতঙ্গ আকর্ষণ।
- হালকা ও অসংখ্য পরাগকণা → বায়ুবাহিত।
- পানিতে ভাসমান পরাগকণা → জলীয় উদ্ভিদে।
- ফুলের বিশেষ গঠন → স্বপরাগযোগ বাধা দেয়।
পরাগ-গর্ভকেশর প্রতিক্রিয়া
- পরাগকণা গর্ভমুণ্ডে অঙ্কুরিত হয়।
- টিউব কোষ → পরাগনালি তৈরি করে।
- জেনারেটিভ কোষ → দুটি শুক্রাণু দেয়।
- একটি শুক্রাণু ডিম্বাণুর সাথে → জাইগোট গঠন করে।
- অন্য শুক্রাণু মেরুকেন্দ্রকের সাথে → ত্রিগুণী এন্ডোস্পার্ম তৈরি করে।
- 👉 একে বলে ডাবল ফার্টিলাইজেশন।
যৌন অসাযুজ্যতা (Self-incompatibility)
কিছু ফুলে স্বপরাগযোগ সম্ভব হলেও নিষেক হয় না।
কারণ → গর্ভমুণ্ডে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া পরাগ অঙ্কুরোদগম রোধ করে।
পুংলিলাহর ও স্ত্রীলিলাহরের উৎপত্তি
- পুংলিলাহর: পরাগকণা অঙ্কুরিত হয়ে পুরুষ গ্যামেটোফাইট তৈরি করে।
- স্ত্রীলিলাহর: ভ্রূণথলি বা এমব্রিও স্যাক হলো স্ত্রী গ্যামেটোফাইট।
নিষেক (Fertilization)
-
শুক্রাণু + ডিম্বাণু → জাইগোট (Diploid)
-
শুক্রাণু + মেরুকেন্দ্রক → এন্ডোস্পার্ম (Triploid)
👉 এটিই Angiosperm-এর অনন্য বৈশিষ্ট্য।
ভ্রূণের পরিস্ফুটন
-
জাইগোট বিভাজিত হয়ে ভ্রূণ তৈরি করে।
-
ভ্রূণের অংশ –
-
Radicle → মূল
-
Plumule → অঙ্কুর
-
Cotyledon → বীজপত্র
-
ফল ও বীজ গঠন
- অণ্ডাশয় → ফল
- অণ্ডাণু → বীজ
- ফল ও বীজ বংশবিস্তার নিশ্চিত করে।
উদ্ভিদ জননের কিছু বিশেষ পদ্ধতি
- এপোমিক্সিস (Apomixis): নিষেক ছাড়াই বীজ উৎপাদন।
- পলিইমব্রিওনি (Polyembryony): এক অণ্ডাণু থেকে একাধিক ভ্রূণ।
- ভেজিটেটিভ রিপ্রোডাকশন: কাণ্ড, পাতা বা মূল থেকে নতুন উদ্ভিদ।
ফল ও বীজ গঠনের তাৎপর্য
- প্রজাতি সংরক্ষণ করে।
- উদ্ভিদের বিস্তার ঘটায়।
- জেনেটিক বৈচিত্র্য বজায় রাখে।
- খাদ্য ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহন করে।
উপসংহার
সপুষ্পক উদ্ভিদের যৌন জনন একটি জটিল কিন্তু সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া। এতে ফুলের বিভিন্ন অংশের সমন্বয়ে পরাগরেণুর উৎপাদন, অণ্ডাণুর গঠন, পরাগযোগ, ডাবল ফার্টিলাইজেশন, ভ্রূণ গঠন ও ফল-বীজের সৃষ্টি ঘটে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পৃথিবীতে সপুষ্পক উদ্ভিদ প্রজাতির বিস্তার ও বৈচিত্র্য বজায় রয়েছে।
📘 সপুষ্পক উদ্ভিদের যৌন জনন – গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (১ নম্বর)
-
আদর্শ ফুল বলতে কী বোঝায়?
👉 যে ফুলে ক্যালিক্স, কোরোলা, অ্যান্ড্রেশিয়াম ও গাইনেশিয়াম সব অংশ থাকে, তাকে আদর্শ ফুল বলে। -
পরাগরেণু কোথায় উৎপন্ন হয়?
👉 অগ্রকেশরের (Anther) পরাগকোষে। -
ভ্রূণথলিতে কয়টি নিউক্লিয়াস থাকে?
👉 ৮টি। -
Angiosperm এ কোন ধরনের নিষেক ঘটে?
👉 ডাবল ফার্টিলাইজেশন। -
এন্ডোস্পার্মের প্রকৃতি কী?
👉 ত্রিগুণী (Triploid)। -
অপোমিক্সিস বলতে কী বোঝায়?
👉 নিষেক ছাড়াই বীজ উৎপাদন। -
পরাগযোগের কয়টি প্রকার?
👉 দুটি – স্বপরাগযোগ ও ইতর পরাগযোগ।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২/৩ নম্বর)
-
স্বপরাগযোগের সুবিধা ও অসুবিধা লিখো।
👉
- সুবিধা: সহজ, নির্দিষ্ট বীজ উৎপাদন।
- অসুবিধা: বৈচিত্র্যের অভাব, দুর্বলতা বৃদ্ধি।
-
ডাবল ফার্টিলাইজেশন কী?
👉 একটি শুক্রাণু ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়ে জাইগোট তৈরি করে এবং অন্য শুক্রাণু মেরুকেন্দ্রকের সাথে মিলিত হয়ে এন্ডোস্পার্ম তৈরি করে। এ দুই প্রক্রিয়াকে একসাথে ডাবল ফার্টিলাইজেশন বলে। -
ইতর পরাগযোগের অভিযোজনের উদাহরণ দাও।
👉 উজ্জ্বল পাপড়ি, সুগন্ধি ফুল, হালকা পরাগ, মধুক্ষেত্র ইত্যাদি। -
এন্ডোস্পার্মের কাজ কী?
👉 ভ্রূণকে পুষ্টি জোগানো। -
মেগাস্পোর মাতা কোষ থেকে কয়টি মেগাস্পোর তৈরি হয়?
👉 চারটি (এর মধ্যে একটি কার্যকর থাকে)।
সংক্ষিপ্ত রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (৫ নম্বর)
-
আদর্শ ফুলের গঠন বর্ণনা করো।
👉 একটি আদর্শ ফুলের চারটি অংশ আছে:
- ক্যালিক্স → কুঁড়িকে রক্ষা করে।
- কোরোলা → পতঙ্গ আকর্ষণ করে।
- অ্যান্ড্রেশিয়াম → পরাগরেণু তৈরি করে।
- গাইনেশিয়াম → অণ্ডাণু তৈরি করে।
-
পরাগরেণুর উৎপাদন প্রক্রিয়া আলোচনা করো।
👉 অগ্রকেশরের পরাগকোষে মাইক্রোস্পোর মাতা কোষ মাইয়োসিসের মাধ্যমে হ্যাপলয়েড পরাগকণা তৈরি করে। প্রতিটি পরাগকণায় টিউব কোষ ও জেনারেটিভ কোষ থাকে। -
ভ্রূণথলি গঠনের ধাপগুলি ব্যাখ্যা করো।
👉
- মেগাস্পোর মাতা কোষ মাইয়োসিস করে ৪টি মেগাস্পোর তৈরি করে।
- একটি কার্যকর থেকে ৩ বার মাইটোসিস বিভাজন হয়।
- এতে ৮টি নিউক্লিয়াস তৈরি হয় → ডিম্বাণু, ২টি সায়নারজিড, ৩টি অ্যান্টিপোডাল, ২টি মেরুকেন্দ্রক।
দীর্ঘ রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (৭/৮ নম্বর)
-
পরাগযোগ কী? এর প্রকারভেদ ব্যাখ্যা করো।
👉 পরাগরেণুর গর্ভমুণ্ডে পৌঁছানোকে পরাগযোগ বলে।
-
স্বপরাগযোগ: একই ফুল বা একই উদ্ভিদের ফুলে ঘটে।
-
ইতর পরাগযোগ: এক উদ্ভিদ থেকে অন্য উদ্ভিদের ফুলে ঘটে (বায়ু, জল, পতঙ্গ ইত্যাদির সাহায্যে)।
-
ডাবল ফার্টিলাইজেশন প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করো।
👉 পরাগনালি গর্ভমুণ্ডে প্রবেশ করে। দুটি শুক্রাণুর মধ্যে—
-
একটি ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়ে জাইগোট তৈরি করে।
-
অন্যটি মেরুকেন্দ্রকের সাথে মিলিত হয়ে এন্ডোস্পার্ম তৈরি করে।
👉 এটি কেবল Angiosperm-এ ঘটে।
-
ফল ও বীজ গঠনের প্রক্রিয়া বর্ণনা করো।
👉
- অণ্ডাণু নিষিক্ত হয়ে জাইগোট → ভ্রূণ তৈরি করে।
- মেরুকেন্দ্রকের সাথে শুক্রাণুর মিলন → এন্ডোস্পার্ম তৈরি হয়।
- অণ্ডাণু → বীজে রূপান্তরিত হয়।
- অণ্ডাশয় → ফলে রূপান্তরিত হয়।
👉 এগুলো WBCHSE, CBSE এবং NEET – তিন ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর।