Welcome to DailyUpdate
কাজী নজরুল ইসলাম-এর পূর্ণ জীবনী (১২০০ শব্দের মধ্যে)
ভূমিকা
বাংলা সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতির আকাশে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন এক দীপ্তিময় নক্ষত্র। তিনি কেবল কবি ছিলেন না, বরং সংগীত রচয়িতা, গীতিকার, নাট্যকার, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবেও সমানভাবে পরিচিত। তাঁর কণ্ঠে বিদ্রোহের জ্বলন্ত আবেগ স্পন্দিত হত, আবার... ভালোবাসার সুরও। তাই তাঁকে একদিকে বলা হয় “বিদ্রোহী কবি”, অন্যদিকে বলা হয় “জাতীয় কবি”।
শৈশব ও পরিবার
কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। তাঁর বাবা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও মাযারের খাদেম। মা জাহেদা খাতুন ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও স্নেহশীলা। ছোটবেলায় নজরুলকে আদর করে ডাকা হতো “দুখু মিয়া”, কারণ দারিদ্র্যের কারণে শৈশব থেকেই তাঁকে নানা কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল।
শিক্ষাজীবন
গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর নজরুল স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হন। কিছুদিন পর অর্থকষ্টের কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। সংসারে সাহায্য করতে তিনি মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করেন, আবার গ্রামের মেলায় লেটো দলের গানও গাইতেন। এই লেটো দলে কাজ করতে গিয়েই তিনি কবিতা, গান, নাটক লেখার অভ্যাস গড়ে তোলেন।
পরবর্তীতে তিনি রানীগঞ্জের স্কুলে পড়াশোনা করেন, কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে তা-ও শেষ করতে পারেননি। তবে তাঁর জ্ঞানার্জনের অদম্য ইচ্ছা তাঁকে স্বশিক্ষিত করে তোলে।
সেনাবাহিনীতে যোগদান
১৯১৭ সালে কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তিনি বাঙালি পল্টনের সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং কিছু বছর করাচিতে অবস্থান করেন। সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় তিনি আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জন করেন। পাশাপাশি কবিতা, গল্প ও গান লেখা অব্যাহত রাখেন। এ সময় তাঁর লেখা “বিদ্রোহী” কবিতা (১৯২২) বাংলা সাহিত্যে ঝড় তোলে।
সাহিত্য জীবন
কাজী নজরুল ইসলাম-এর সাহিত্যকর্ম বহুমাত্রিক।
- কবিতা: তাঁর কবিতায় বিদ্রোহ, মুক্তির ডাক, সমতা, মানবপ্রেম ও ভ্রাতৃত্ববোধের কথা উঠে এসেছে। “বিদ্রোহী”, “কাণ্ডারী হুঁশিয়ার”, “দুর্দিনের যাত্রী”, “সাম্যবাদী” প্রভৃতি কবিতা যুগান্তকারী।
- গান: নজরুল প্রায় ৪,০০০ গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন, যা আজ “নজরুলগীতি” নামে পরিচিত। তাঁর গানে প্রেম, ভক্তি, দেশপ্রেম, বিপ্লব—সবকিছুই পাওয়া যায়।
গল্প ও উপন্যাসের মধ্যে নজরুলের গুরুত্বপূর্ণ রচনার তালিকায় রয়েছে— “বাঁধনহারা”, “রিক্তের বেদনা”, “শিউলি মালা” এবং “কুহেলিকা”।
- নাটক: “ঝাঞ্জা”, “পুতুলের বিয়ে”সহ একাধিক নাটক লিখেছেন।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কারাবরণ
নজরুল শুধু সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্বাধীনতার অকুতোভয় সৈনিক। তাঁর লেখা “দর্পহরণ” নামক কবিতায় ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে কঠোর আঘাত হানা হয়। এর ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় ১৯২৩ সালে। কারাগারে থেকেও তিনি লিখে যান অমর সৃষ্টি “রাজবন্দীর জবানবন্দী”।
প্রেম ও পরিবার
১৯২৪ সালে নজরুল প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেন। তাঁদের দুই ছেলে হয়েছিল, তবে দুজন অল্প বয়সেই মারা যান। পরবর্তীতে আরও দুই সন্তান জন্ম নেয়—কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। সংসারের সুখ-দুঃখের মাঝেও নজরুল সাহিত্যকর্ম চালিয়ে যান।
সংগীতে অবদান
বাংলা সংগীতে নজরুল এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। তিনি হিন্দুস্তানি রাগের সাথে বাংলা কথা মিশিয়ে অসংখ্য গান রচনা করেন। ইসলামি ভাবধারার গান যেমন লিখেছেন, তেমনি শ্যামাসংগীত, কীর্তন, ভক্তিগানও রচনা করেছেন। তাঁর সৃষ্টিকে বলা হয় “সর্বধর্ম সমন্বয়ের গান”।
অসুস্থতা ও নিস্তব্ধ জীবন
১৯৪২ সালে হঠাৎ করে নজরুলের স্বাস্থ্যে অস্বাভাবিক সমস্যা দেখা দেয়। তিনি “পিক্স ডিজিজ” নামে একটি বিরল স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হন। এর প্রভাবে ধীরে ধীরে তার কথা বলার, লেখার ও চিন্তাশক্তি কমে যেতে থাকে। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তিনি এই রোগের সঙ্গে সংগ্রাম করেন।
বাংলাদেশে আগমন ও সম্মাননা
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর কাজী নজরুল ইসলামকে “জাতীয় কবি” হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। পরবর্তী বছর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে দেশে আমন্ত্রণ জানান। এরপর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং নিয়মিত ভাতা প্রদান করা হয়।
মৃত্যু
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় হাসপাতালে কাজী নজরুল ইসলাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে ঢাকায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পাশে সমাহিত করা হয়।
সাহিত্য ও ভাবধারার মূল্যায়ন
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন মানবতার কবি। তাঁর কবিতা ও গানে সমতা, ন্যায়বিচার, প্রেম ও বিদ্রোহের মিশেল পাওয়া যায়। তিনি ধর্মীয় ভেদাভেদ মানতেন না। তাঁর সৃষ্টিকর্ম আজও বাঙালির প্রেরণা।
উপসংহার
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম এক চিরজাগরূক প্রতীক। তিনি ছিলেন নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর, প্রেমিক হৃদয়ের কবি ও জাতির বিবেক। তাই তাঁকে “জাতীয় কবি” বলা একেবারেই যথাযথ। তাঁর অমর সৃষ্টি আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়—
“মানুষের উপরে মানুষ কখনোই বড় নয়।”